নাম তার সাজু আহমেদ। তবে সবাইকে পরিচয় দেন তিনি রুবেল নামে। স্থানীয়রা তাকে যমুনার টিভির সাংবাদিক হিসেবে চেনেন। দীর্ঘদিন ধরে সাজু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘যমুনা নিউজ ওয়ার্ড’ নামে একটি আইডি ব্যবহার করছেন। অভিযোগ রয়েছে, ওই আইডির প্রোফাইল ও কাভার ফটোতে যমুনা টিভির লোগো হুবহু ব্যবহার করেন সাজু। এরপর থেকে তিনি সাংবাদিক পরিচয়ে হুমকি-ধামকি দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়া ছাড়াও নানা প্রতারণা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন।
সম্প্রতি সাজুর বিরুদ্ধে দিনাজপুরের পারবর্তীপুর রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি) থানায় তিনটি সাধারণ ডায়েরী (জিডি) করেছে পুলিশ। এতোদিন বিষয়টি গোপন থাকলেও জিডি’র পর সাজুর প্রতারণার ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছে পারবর্তীপুরজুড়ে। কে এই সাজু, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন সবার মুখেমুখে। বিষয়টি নজরে আসলে অনুসন্ধান করে সাংবাদিক পরিচয়ে সাজুর দাপট, হুমকি-ধামকি ও টাকা দাবির বিস্তর তথ্য-প্রমাণ হাতে আসে যমুনা টিভির গাইবান্ধা প্রতিবেদকের।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিনে পারবর্তীপুর বাজার, স্টেশন এলাকা ও বাস টার্মিনালসহ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে কথা হয় ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি ও একাধিক ভুক্তভোগীসহ স্থানীয়দের সঙ্গে। এসময় তারা কথিত সাংবাদিক সাজুর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ করেন। একাধিক ভুক্তভোগী ও স্থানীয়রা জানান, সাংবাদিক পরিচয়ে সাজু একটি বাজাজ পালসার মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ান। অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন পেশার মানুষকে সংবাদ প্রকাশের ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয় সাজু। শহর কিংবা গ্রামে কোন অপ্রীতিকর ও তুচ্ছ ঘটনা হলেই সংবাদ প্রকাশ কিংবা প্রকাশ না করতে টাকা দাবি করেন তিনি। টাকা না পেলেই মিথ্যা-ভিত্তিহীন ও মনগড়া সংবাদ প্রকাশ করেন কথিত সাংবাদিক সাজু।
শুধু পারবর্তীপুরেই নয়, এই সাজু ফুলবাড়ি, বিরামপুর ও হাকিমপুরসহ রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় রাতদিন দাপিয়ে বেড়ান। দীর্ঘদিন ধরে সাজুর দাপট-দাম্ভিকতা ও ভয়ভীতির কারণে অনেকে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সাজুর বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতের অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। সাজুর অন্তত ৮-১০টি বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির নাম্বার সিম আছে। তিনি ঘটনা ও ব্যক্তি-সুযোগ বুঝেই নাম্বারগুলো ব্যবহারে ভয়ভীতি দেখান বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীসহ স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে পাবর্তীপুর নতুন বাজারের বাসিন্দা মুক্তি মাহামুদুল হাসান বিপ্লব জানান, এই সাজু একজন চিহ্নত প্রতারক। তার সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের সখ্যতা রয়েছে। বাবুল নামে এক মাদক ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধের জেরে তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন কথিত সাংবাদিক সাজু। এরপর সাজু তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দেয়।সাজু 01922128101, 01712559983, 01312559983 ও 01710491455 নাম্বার থেকে ফোন করে এই হুমকি দেন। হুমকির কয়েকটি অডিও রেকর্ড তার সংরক্ষণে আছে। হুমকির বিষয়টি তিনি মৌখিকভাবে থানা পুলিশকে অবগত করেন।
এছাড়া পারবর্তীপুর পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের গুলপাড়ার বাসিন্দা সাকিব হোসেন ডলার, ব্যবসায়ী বিপ্লব ও আশরাফুলসহ কয়েকজন কথিত সাংবাদিক সাজুর হুমকি-ধামকি ও প্রতারণার নানা অভিযোগ তুলে ধরেন প্রতিবেদকের কাছে।
সাজুর বিষয়ে জানতে কথা হয় পারবর্তীপুর পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ড কমিশনার মো. নুরে আলম সিদ্দিকির সঙ্গে। তিনি জানান, সাজুকে স্থানীয়রা সাংবাদিক হিসেবে চেনেন। যে কোন ঘটনা কিংবা মাদক ব্যবসায়ী আটক-গ্রেফতার হলে সাজু সংবাদ প্রকাশের ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করেন। ইতোমধ্যে তার কাছে স্থানীয় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ব্যবসায়ীসহ অনেকে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ভূয়া পরিচয়ে সাজুর হুমকি-ধামকি থেকে বাদ পড়েনি পুলিশ-প্রশাসন। গত ১২ মে রাতে সাজু 01922128101 নাম্বার থেকে আমার মোবাইলে ফোন করে ভিজিএফ চালের ১০টি স্লিপ চান। স্লিপ না দিলে তিনি কমিশনার পদ দেখা নেয়াসহ বাসায় অভিযান চালানোর হুমকি দেন।
তিনি আরও জানান, ঈদুল-উল ফিতরের দুইদিন আগে গুলপাড়ার মাদক ব্যবসায়ী বাবলু ওরফে চেমা বাবলুর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তার ছেলে মোকছেদুল ওরফে ভোদলকে গাঁজা ও ইয়াবাসহ আটক করে এক বছরের কারাদন্ড দেন ভ্রাম্যামাণ আদালতের বিচারক সহকারি কমিশনার (ভূমি) প্রীতম সাহা। ঘটনাটি জানতে পেরে কথিত সাংবাদিক সাজু সহকারী কমিশনারকে ফোন করে তথ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরির পরিচয় দিয়ে ভোদলকে কারাদন্ডের ঘটনা জানতে চান। এসময় সাজু কমিশনারকে পদ থেকে ওএসডি করাসহ বিভিন্ন হুমকি দেন।
ভুয়া সাংবাদিক পরিচয়ের সাজু হুমকি ও প্রতারণার বিষয়ে কথা হয় পারবর্তীপুর রেলওয়ে (জিআরপি) থানার (ওসি) আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে। তিনি জানান, গত ২ এপ্রিল সাজু প্রথমে আমাকে ফোন করে এএসপি দক্ষিণ খানের পরিচয় দেন। এরপর সাংবাদিক পরিচয়ে দুইদিন কনস্টেবল (আরএসবি) আমিনুল ইসলামকে ফোন করে। তাকে বদলির হুমকি দেয়াসহ একটি অভিযোগের সংবাদ প্রকাশ না করা সত্বে ২০ হাজার টাকার দাবি করেন। এছাড়া ডিউটি অফিসারকে ফোন করেও বিভিন্ন হুমকি দেয় সাজু। এ ঘটনায় গত এক মাসে সাজুর বিরুদ্ধে থানায় পৃথক তিনটি সাধারণ ডায়েরী (জিডি) করা হয়েছে। সাজু একাধিক মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করেন। এরেইমধ্যে একটি নাম্বারের রেজিষ্ট্রেশন যাচাই করলে দেখা যায়, নাম্বারটি লালমনিরহাটের এক নারীর নামে রেজিষ্ট্রেশন করা আছে। তাকে দ্রুত শনাক্ত করাসহ গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে, যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা ওই ফেসবুক আইডির লিংক : https://www.facebook.com/profile.php?id=100079733690966
তবে এই আইডিতে crimebirta.com, jomunanews.com এবং nbanglatv.com নামে নিউজ পোর্টালের নিউজ লিংক শেয়ার-পোস্ট করতে দেখা যায়। এসব নিউজ পোর্টালের বাণিজ্যিক কার্যালয় ঢাকা উল্লেখ আছে।
এরইমধ্যে সাজুর নাম-ঠিকানার একটি কার্ড প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেখানে নাম সাজু আহম্মেদ, পিতা- আলতাব হোসেন, মাতা- সাহেবজন নেছা ও ঠিকানা রংপুর সদর উপজেলার ২ নং ওয়ার্ডের দক্ষিন পানাপুকুর উল্লেখ আছে।