সন্তানের খুনিদের বিচার চাই। তবে আমার জীবন থাকতে আমার কলিজার কলিজা কাটতে দিমু না।
আমার কলিজার টুকরা সন্তানকে তারা গুলি করে হত্যা করেছে। আদর ভালোবাসা দিয়ে আদরের সন্তানকে কবরে শেষ বিদায় দিয়েছি। তার লাশ আর তুলতে দিব না। প্রয়োজনে আমি মা জীবন দিব, তবুও সন্তানের লাশ তুলতে দিমু না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত মিরাজুল ইসলাম মিরাজের মা মোহসেনা বেগম এমন করে আকুতি জানান গণমাধ্যমের কাছে।
মিরাজুল ইসলাম মিরাজ লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের বারঘড়িয়া আনছার খাঁর পুকুরপাড় এলাকার আব্দুস ছালামের ছেলে। নিজ গ্রামে পারিবারিক করবস্থানে গত ৮ আগস্ট তাকে দাফন করা হয়।
মিরাজ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মিরাজের মরদেহ উত্তোলন করে মর্গে পাঠাতে ইতোমধ্যে ঢাকা সিএমএম আদালত লালমনিরহাট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছেন।
জানা গেছে, স্থানীয় মহিষখোচা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০২১ সালে এসএসসি পাশ করে সিএনজি চালক বাবার সঙ্গে ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকায় পাড়ি জমায় মিরাজুল ইসলাম মিরাজ। সেখানে ভাড়া বাসায় থাকত মিরাজের পুরো পরিবার। ঢাকা দনিয়া মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয় সে। পড়ালেখার পাশাপাশি একটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দোকানের কর্মচারী ছিলেন মিরাজ। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা ছোট দুই ভাইয়ের লেখাপড়াসহ পুরো সংসার চলতো মিরাজের আয়ে। বাবার চিকিৎসায় ৩/৪ লাখ টাকা ঋণও করেছে মিরাজ। সেই ঋণ পরিশোধে আর সংসারের হাল ধরতে লেখাপড়ার পাশাপাশি দোকানে কাজ নেয় মিরাজ।
গত ৫ আগস্ট হাসিনা পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে অন্যদের মতো যাত্রাবাড়ি থানার সামনে মাছের আড়ত এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেয় মিরাজ। তার খালাত ভাই কারখানা শ্রমিক মাজেদুল ইসলামও তার সঙ্গে যোগ দেয় মিছিলে। সেখানে পুলিশের গুলিতে দুই ভাই মিরাজ ও মাজেদুল গুলিবিদ্ধ হয়। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। পরদিন সেখান থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় মিরাজকে। অস্ত্রোপচার করে মিরাজের শরীর থেকে গুলি বের করা হলেও এর দুই দিন পর ৮ আগস্ট মারা যান মিরাজুল ইসলাম মিরাজ। তার সঙ্গে যাওয়া গুলিবিদ্ধ খালাত ভাই মাজেদুল ইসলাম চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে সুস্থ।
মিরাজের মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবা আব্দুস ছালাম বাদী হয়ে লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন এমপিকে প্রধান করে সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদসহ ৩৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ২/৩শ জনের নামে ২৪ আগস্ট যাত্রাবাড়ি থানায় একটি হত্যা মামলা ( নং-১৭(৮) ২৪) দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তের স্বার্থে মৃত মিরাজের ভিসেরা (ময়নাতদন্ত) প্রতিবেদনের জন্য কবর থেকে মরদেহ উত্তোলনের অনুমতি চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। যার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা সিএমএম আদালতে বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হক মরদেহ উত্তোলনে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে লালমনিরহাট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে আদেশ দেন।
এদিকে কোনোভাবেই মরদেহ উত্তোলন করতে দিতে রাজি নন মিরাজের মা মোহসেনা বেগম। সার্বক্ষণিক পাহারা দিচ্ছেন মেধাবী সন্তানের করব। কারও আসার কথা শুনলেই দৌড়ে যান ছেলের কবরের পাশে। যাতে কেউ লাশ তুলতে না পারে সেজন্য প্রায় নির্ঘুম রাতও কাটছে তার।
মিরাজের মা মোহসেনা বেগম বলেন, সন্তানের খুনিদের বিচার চাই। তবে আমার জীবন থাকতে আমার কলিজার কলিজা কাটতে দিমু না। আমার কলিজার টুকরা সন্তানকে তারা গুলি করে হত্যা করেছে। আদর ভালোবাসা দিয়ে আদরের সন্তানকে কবরে শেষ বিদায় দিয়েছি। তার লাশ আর তুলতে দিব না। প্রয়োজনে আমি মা জীবন দিব, তবুও সন্তানের লাশ তুলতে দিমু না।
তবে মিরাজের বাবা মামলার বাদী আব্দুস ছালাম বলেন, শুনেছি মামলার তদন্তের স্বার্থে ছেলের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করা হবে। যদি মামলার স্বার্থে তা করতেই হয়। তাহলে আপত্তি নেই। তবুও আইনজীবীদের সঙ্গে বসে যদি মরদেহ উত্তোলন ছাড়াও বিচারের পথ থাকে তবে মরদেহ উত্তোলন না করার আবেদন করা হবে। বিষয়টি নিয়ে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের সঙ্গে মৌখিক আলোচনাও করেছি।
মরদেহ উত্তোলনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা আদিতমারী থানার এসআই আমিনুল ইসলাম বলেন, আদালতের নির্দেশনা পেয়েছি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়ে দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দিলে মিরাজের মরদেহ উত্তোলন করে লালমনিরহাট সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হবে।
আদিতমারী থানার ওসি মাহমুদ উন নবী বলেন, এখন পর্যন্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে মরদেহ উত্তোলনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠি আসেনি। এলে নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপাতত ঢাকা সিএমএম আদালতের আদেশের অনুলিপি পেয়েছি।