সাম্প্রতিক বন্যায় জেলার হাসপাতালগুলোর নিচতলা তলিয়ে গেছে। এতে স্বাস্থ্য সেবা অনেকাংশে ভেঙে পড়েছে।
এ অবস্থায় জেলা শহরে একের পর এক হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ করেও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারছে না রোগীর স্বজনরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে শহরের সাতটি হাসপাতালকে ডেডিকেটেড ঘোষণা করে চিকিৎসক দিয়ে সরকারি মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করছে জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ।
২৫০ শয্যা হাসপাতালে বন্ধ ছিল বিদ্যুৎ সরবরাহ। পাওয়া যাচ্ছে না রোগীর খাবার ও পথ্য। বাথরুম ও পরিচ্ছন্নতার পানিও নেই হাসপাতালে। জেনারেটর রুমে পানি ঢুকে বিকল হয়ে গেছে যন্ত্র। স্বল্প পরিসরে দুজন চিকিৎসক ও দুজন নার্স দিয়ে কোনো রকম প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসা মিলছে না জেলার সর্ববৃহৎ এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে। একই অবস্থার খবর পাওয়া গেছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠান থেকেও।
জেলা সদর হাসপাতালে সরেজমিন দেখা যায়, ১ ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে হাসপাতালের প্রবেশপথ। ভেতরে ঢুকতেই হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে দেখা হয়। তারা জানান, বন্যার কারণে গত বুধবার রাতে আকস্মিকভাবে ফেনী সদর হাসপাতালের নিচতলা ডুবে যায়।
এ সময় হাসপাতালের আশপাশ পানির নিচে তলিয়ে যেতে থাকে। এতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী ও দায়িত্বরত চিকিৎসক–কর্মকর্তা, কর্মচারীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হাসপাতালের নিচতলায় থাকা নবজাতক শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র, স্টোর রুম, ডায়ালাইসিস ইউনিট, ডেন্টাল ইউনিটের সরঞ্জামে পানি ঢুকেছে। অবস্থা বেগতিক থাকায় জরুরি বিভাগের কার্যক্রম নিচতলা থেকে সরিয়ে দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎ সরবরাহ।
তারা জানান, জেনারেটর চালু করার কিছুক্ষণ পর জেনারেটর কক্ষে পানি ঢুকে সেটিও বিকল হয়ে পড়ে। প্রবল অন্ধকারে সবার মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে পাঁচদিন ধরে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। নৌকা ও ট্রলার ব্যবহার করে জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গুরুতর রোগী হাসপাতালে নিয়ে আসা হলেও মেলেনি কোনো চিকিৎসাসেবা। সড়ক ও হাসপাতাল এলাকায় ৫–৬ ফুট পানি থাকায় কর্মস্থলে আসতে পারেননি চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা।
সরজমিনে আরও দেখা যায়, পানি কমে যাওয়ায় নিচতলায় পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা রোগীদের দ্বিতীয় তলায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন দুজন চিকিৎসক ও দুজন সিনিয়র স্টাফ নার্স। এখনো হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে দুই শতাধিক রোগী। গত দুদিন সড়কে পানি বেশি থাকায় আগত রোগীর সংখ্যা সীমিত ছিল। মঙ্গলবার পানি নেমে যাওয়ার পর জরুরি বিভাগে রোগীদের উপচে পড়া ভিড় শুরু হয়। প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় রোগীদের কোনো মতে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শহরের ডেডিকেটেড হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে।
হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগী ও স্বজনরা জানান, গত বুধবার থেকে হাসপাতালে আলো জ্বলেনি। বাথরুমে পানি নেই। হাসপাতালে ছিল না কোনো চিকিৎসক। পাওয়া যায়নি সরকারি খাবার ও পথ্য। মাঝেমধ্যে স্বেচ্ছাসেবকদের থেকে পাওয়া শুকনো খাবারে দিন পার করতে হচ্ছে। তবে স্বেচ্ছাসেবকরা মঙ্গলবার শুকনো খাবার, পানি ও মোমবাতি দিয়েছেন রোগীদের।
এমন অবস্থা শুধু ফেনী জেলা সদর হাসপাতালেরই নয়, একই চিত্র বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোরও।
এই অবস্থার খবর পেয়ে মুন্সিগঞ্জ থেকে ফেনীর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে এসে গত কয়েকদিন স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন সফিকুল ইসলাম নামে এক যুবক। গত শুক্রবার এ হাসপাতালে আসেন তিনি। দেখেন নতুন বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন ওয়ার্ডে রোগী আছে। কিন্তু কোনো চিকিৎসক বা নার্স নেই। পুরাতন ভবনে দুজন করে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও নার্সকে দেখেন। জেলার সর্ববৃহৎ হাসপাতালের এমন অবস্থা দেখে সফিকুল এখানে থেকে গেছেন। ও রোগীদের খাবার–পথ্যের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ শুরু করেন।
ফরিদুল ইসলাম নামে এক রোগীর স্বজন জানান, গত রোববার তার সন্তানের ডায়রিয়া শুরু হয়। অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত তাকে শহরের আলকেমি হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। সেখানে গিয়ে দেখেন হাসপাতালে তালা। সেখানকার নিরাপত্তারক্ষাকর্মী তাকে জানান, হাসপাতালে বিদ্যুৎ, পানি, চিকিৎসক–নার্স নেই। তাই এটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
পরে সন্তানকে দ্রুত রিকশাযোগে পানি পার হয়ে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে এসে একই অবস্থা দেখেন ফরিদুল। হাসপাতাল থেকে তাকে প্রাইভেট হাসপাতালে যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়। ২ ঘণ্টা পানিতে দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো সেবা না পাওয়ায় একটি ভ্যানের মাধ্যমে ছেলেকে অন্য হাসপাতালে নেন তিনি।
এমন বিড়ম্বনার শিকার ফরিদের মতো আরও কয়েকজনও হয়েছেন। বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও পরিস্থিতি আগের মতোই রয়েছে বলে জানা গেছে।
২৫০ শয্যা ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আসিফ ইকবাল বলেন, বন্যায় ফেনীর হাসপাতালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যার কারণে জেলা প্রশাসনের পরামর্শে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে শহরের সাতটি প্রাইভেট হাসপাতালকে ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণা করা হয়েছে। এসব হাসপাতালে সরকারি ৩০ চিকিৎসককে রোস্টার দায়িত্ব দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে না এলেও ডেডিকেটেড হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেছেন। হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হওয়া রোগীদের সরকারি মূল্যে সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে। ’
স্বাস্থ্য বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ডা.ইফতেখার আহমদ বলেন, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম থেকে চিকিৎসক এনে ফেনীতে থাকা চিকিৎসকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতাল ডেডিকেটেড করে জরুরি অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে। আমরা দ্রুত ফেনী জেনারেল হাসপাতালসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাভাবিক কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করছি। অচিরেই সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক ধারায় ফিরবে।