চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ির রামগড়ের দূরত্ব ৬১ কিলোমিটার। সড়কপথে যেতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টা।
অপরদিকে চট্টগ্রাম থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ৪৩৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যশোরের বেনাপোল পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ১৪ ঘণ্টা। চিকিৎসা, ভ্রমণ, ব্যবসা ও শিক্ষাগ্রহণে চট্টগ্রামের অধিবাসীদের ভারতমুখি হওয়ার প্রবণতা বেশি।
সড়ক, রেল ও আকাশপথে যেতে দুর্ভোগের পাশাপাশি গুনতে হয় বাড়তি অর্থ। চট্টগ্রাম থেকে বিমানে দৈনিক গড়ে যাত্রী যায় ৭২ জন। অন্যরা ট্রেনে আখাউড়া স্থলবন্দর হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা যাচ্ছে। এ অবস্থায় রামগড় স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শুরু হলে যাত্রীরা সহজেই প্রতিবেশী দেশে যেতে পারবেন।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে রামগড় মহকুমা দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে সাব্রুমের যোগাযোগ ছিল। স্বাধীনতার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। রামগড় স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন চালু হলে দীর্ঘ সময় পর আবারও চট্টগ্রামের সাথে ভারতের সেতুবন্ধন তৈরি হবে।
ভারতীয় সহকারী হাই কমিশন-চট্টগ্রাম কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে দিনে গড়ে ৩৫০টি ভিসা ইস্যু করা হয়। ২০১৫ সালে ভারতে গেছেন ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৪ জন, ২০১৬ সালে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৫৪ জন, ২০১৭ সালে ১ লাখ ৬০ হাজার ১৭৯ জন, ২০১৮ সালে ১ লাখ ৮৯ হাজার ২৫২ জন, ২০১৯ সালে ২ লাখ ৩০ হাজার ৭৩৩ জন। ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভারত ভ্রমণ করেছেন উল্লেখযোগ্য পর্যটক, যাদের তথ্য পাওয়া যায়নি।
২০১৫ সালের ৬ জুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু-১ এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফেনী নদীর তীরবর্তী খাগড়াছড়ির রামগড় ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম অংশে ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৪১২ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। এ সেতুটি ২০২১ সালের ৯ মার্চ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন। পরে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন হয় রামগড় ইমিগ্রেশন ভবন ও বিজিবি চেকপোস্ট স্থাপনের কাজ, নিয়োগ দেওয়া হয় লোকবল।
এরই মধ্যে জাইকা’র তত্ত্বাবধানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ককে যুক্ত করতে ৮টি সেতু ও ৮টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। একই প্রকল্পের আওতায় রামগড়ের ফেনীরকূল এলাকায় প্রধান সড়কে রোড লোড স্কেল স্থাপনের কাজও শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের কাজ চলছে বলে জানিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রায় ১১২ কিলোমিটার দূরে রামগড় স্থলবন্দর। জানা গেছে, আমদানি-রপ্তানির পাশাপাশি যাতায়াতের সুবিধার্থে শিগগিরই চালু হতে যাচ্ছে এই বন্দর। এতে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যসহ মেঘালয়, আসাম, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচল তথা সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৩ ঘণ্টায় ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্য ভারতের ৭টি রাজ্যে যাবে। পাশাপাশি অল্প সময়ে স্থলবন্দর হয়ে আগরতলা বিমানবন্দর দিয়ে ভারত যেতে পারবেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ।
এদিকে রামগড় স্থলবন্দরের কার্যক্রম পুরোপুরি শুরুর আগেই এই বন্দর দিয়ে মাস দুয়েকের মধ্যে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, রামগড় স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন চালুর বিষয়ে ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। বর্তমানে বন্দরের প্রশাসনিক ও ইমিগ্রেশন ভবন নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। এ কারণে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম শুরু করতে দেরি হচ্ছে। তবে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শুরু করতে প্রস্তুত রয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
সাব্রুম স্থলবন্দর কর্মকর্তা দেবাশীষ নন্দী জানান, যাত্রী পারাপারে সাব্রুম স্থলবন্দর পুরোপুরি প্রস্তুত। এখন বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।
রামগড় স্থলবন্দরের প্রকল্প পরিচালক মো. সরোয়ার আলম বলেন, সীমান্তের ১৫০ গজের ভেতরে হওয়ায় রামগড় স্থলবন্দরের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে সময়মতো ভারতের অনাপত্তিপত্র পাওয়া যায়নি। তাই এ বন্দরের বিভিন্ন স্থাপনার নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে দেরি হয়েছে।
রামগড় উপজেলা নির্বাহী অফিসার মমতা আফরিন আমাদের পত্রিকাকে জানান, ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শুরু হলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের মানুষ রামগড় ও সাব্রুম সীমান্ত দিয়ে ভারতে যেতে পারবেন। একইভাবে ভারতের ত্রিপুরাসহ আশপাশের রাজ্যের মানুষও এই সীমান্ত পথে বাংলাদেশে আসতে পারবেন।
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, রামগড় স্থলবন্দর চালু হলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য আরও বাড়বে। চট্টগ্রাম থেকে বেনাপোল যেতে অনেক সময় প্রয়োজন হয়। রামগড় স্থলবন্দর চালু হলে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে যেসব পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়, তা আরও কম সময় ও খরচে আমদানি করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিবেচনায় রামগড় স্থলবন্দর বেনাপোলের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, চট্টগ্রাম বন্দর ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের সুফল কাজে লাগাতে রামগড় অধিক ভূমিকা রাখতে পারে। এই স্থলবন্দরকে কেন্দ্র করে মীরসরাই ও ফটিকছড়িসহ উত্তর চট্টগ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। স্থলবন্দর চালু হলে রামগড় থেকে ভারতের ওপর দিয়ে সিলেটের মাধবপুর পর্যন্ত এবং নরসিংদী-মৌলভীবাজার পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা গেলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেটে যাতায়াতে সুবিধা পাবে চট্টগ্রামবাসী।